জীবনের সর্বক্ষেত্রে কর্পোরেট দখলদারি

মনোজ ভট্টাচার্য


স্বাধীনোত্তর ভারতে এমন সংকটকাল আর কখনোই আসে নি৷ আমাদের অভিজ্ঞতা ছাডা ইতিহাসের পষ্ঠাতে এমন উল্লেখ আর লক্ষ করা যায় নি৷ এই সার্বিক সংকটকালের জন্য করোনা বা কোভিড-১৯ অতিমারি অবশ্যই একটি বড কারণ৷ কিন্তু সেটাই সব নয়৷ এর আগে, প্রায় একশ বছর আগে স্প্যানীশ ফ্লু বা বম্বে ফ্লু অনুজীবীর সংক্রমণকালে অত্যাচারী ইংরেজ শাসনের যন্ত্রণাবিদ্ধ সময়ে এমন এক অবস্থা হয়েছিল বলে জানা নেই৷ তার বেশ কয়েকবছর আগে ভারতের নানা স্থানে বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে বুবোনিক প্লেগ মহামারির কবলে বঔ প্রাণ বিনষ্ট হয়েছিল৷ সে তো প্রায় উনিশ শতকের একেবারে শেষদিকে৷ বম্বের কমিশনার মিঃ র‌্যান্ড এবং তাঁর দেহরক্ষীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল উদাহরণ চাপেকার ভাইয়েরা৷ তাঁরা ফাঁসির সাজা পেয়েছিলেন৷ তখন লোকমান্য তিলক জাতীয় কংগ্রেসের নেতা৷ সেইকালে এত সব সত্ত্বে কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে পরাধীনতার গ্লানি পনিবেশিক শাসনের নিকষ্ট আচরণের যন্ত্রণা ছাডা অর্থনৈতিক সমাজ-সংস্্কতিগত সমস্যা এমন মাত্রা লাভ করে নি৷

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অতি বিস্তৃত ইতিহাস বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য নয়৷ কিন্তু এ বিষয় তো সকলেই জানেন যে, ইতিহাস বিস্মত হলে বারংবার ভুলের ফাঁদে পডতে হয়৷ সেই হিসেবে হয়তো কোথা কোথা ইতিহাসের, সুদূর অতীতের নয়, বিগত দু’তিন দশকের ইতিহাস সম্পর্কিত দু’একটি উল্লেখ থাকতে পারে৷ অবশ্যই করোনা সংক্রমণ বা সমগোত্রীয় কোন রোগ ব্যাধি নিয়ে আলোচনার বিষয় এক্ষেত্রে আসবে না৷

ভারতের বর্তমান মুখ্য সংকট অবশ্যই অর্থনৈতিক৷ করোনার প্রাদুর্ভাব হবার বেশ আগেই এমন সংকটের অবস্থিতি লক্ষ করা গেছে৷ বিশ্বায়ন বা নয়া উদারবাদ আশ্রিত অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলি একেবারে শুরু থেকেই এদেশের সাধারণ মানুষের বিশেষ করে, শ্রমকারী মানুষদের স্বার্থহানি করেছে অথবা তার পরিকল্পনা করেছে৷ পূর্বে উল্লিখিত হলে পুনর্বার বলতে হয় যে, চলমান শ্রম পুঁজির হিংস্র সংঘাতে রাষ্ট্র সরাসরি পুঁজির পক্ষালম্বন করে জনসমাজের সামূহিক স্বার্থ বরবাদ করে চলেছে৷ কখনো কখনো জনজীবনের চূডান্ত অধঃপাত বা অধোগতি লক্ষ করে শাসক শ্রেণি দল শঙ্কিত হয় নি, এমন নয়৷ অনেক সময় দেখা গেছে যে, তেমন শঙ্কার প্রাবল্যে বেশ কিছু জনমোহিনী বা অনেকক্ষেত্রে কিছু জনকল্যাণকামী কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে৷

এসবের অর্থ এমন নয় যে, শাসকশ্রেণির চৈতন্যোদয় হয়েছে এবং তারা জনকল্যাণের স্বার্থে নিজেদের নীতিগুলি সব পাল্টে ফেলেছে! কিছুটা গণবিক্ষোভ সম্পর্কিত আশঙ্কা আর কিছুটা মানবজীবনে চরম সঙ্কট এবং তার আন্তর্জাতিক প্রচারের ফলে বিশ্বনিন্দিত একটি দেশ হিসেবে পরিগণিত হবার ভীতি সম্ভবত ক্রিয়াশীল থেকেছে৷ আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনীতির ঠানামা, পরিবর্তন বা নানা সিদ্ধান্ত অনুসিদ্ধান্তগুলি ভারতের শাসকদলগুলিকে ভাবিত করে নি, তা নয়৷

দুনিয়া জুডে সংবাদ আদান প্রদান ক্ষেত্রে (informatics) অভাবিতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে৷ এর ফলে অনেক সংবাদই আর গোপন থাকছে না৷ জুলিয়ান আসেঞ্জের উইকিলিকস ছাডা বঔ খবর বেরিয়ে পডছে৷ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেঁসেলের খবর ফাঁস করে দেবার অপরাধে অনেকদিন যাবৎ আসেঞ্জ কারান্তরালে৷ একসময় লন্ডনে ইকুয়েডর রাষ্ট্রের দূতাবাসে যেটুকু রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন, এখন আর তা নেই৷ এসব অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ৷ কিন্তু যা উল্লেখ করতে এত কথা উঠলো তা হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে কোন দেশের কোন ঘটনাই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা বিচ্ছিন্ন নয়৷ বরং গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত৷ ভারতের বর্তমান ভীতিজনক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রাথমিক আলোচনাতে এই বৈশিষ্ট্যটি নিবিডভাবে স্মরণে রাখতে হবে৷

ইদানিংকালে ভারতের সংসদে দেশের কষিব্যবস্থায় বিরূপ পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে যে তিনটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিনান্স গত ৫ জুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পরিকল্পিতভাবে ঘোষণা করেছিল সেগুলি বর্তমান সংসদ অধিবেশনে জোর জবরদস্তি আইনে রূপান্তরিত করা হল৷ এছাডা মোদী সরকারের গত্যন্তর ছিল না৷ দের বা এই সরকার যে গতিতে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কুক্ষিগত হয়ে পডেছে তাতে, অন্য কী-ই বা করার থাকতে পারে৷

কষি সংক্রান্ত এইসব আইন আন্তর্জাতিক স্তরের বড বড বঔজাতিক কষি ব্যবসায়ীদের জন্য অপার সুযোগ করে দেবে৷ এদেশের পুঁজি মালিকরা যেমন আম্বানির রিলায়েন্স বা জি প্রত্যক্ষভাবে কিংবা বিদেশি কোম্পানিগুলির এজেন্ট হিসাবে বেশ দুহাতে লুণ্ঠন করার সুযোগ পেয়ে যাবে৷ ভারতের জল জঙ্গল আসমান তো পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে নীলামে তোলাই হচ্ছে৷ মাটির সঙ্গে ফসল এই প্রক্রিয়াতেই দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে এমন কি, অভুক্ত রেখে ব্যবসায়ীদের অতি বিপুল উদরপূর্তিতে কাজে লাগবে৷ সম্পদের মেরুকরণ আর দ্রুত বেগে সংঘটিত হবে৷ আর বিত্ত সম্পদের মেরুকরণ প্রক্রিয়াকে অবারিত করতে সহজপথ নিয়েই চলবে সংঘপরিবার৷ ধর্মের ভিত্তিতে মানবসমাজকে আর হিংস্রভাবে বিভক্ত করবে আর এস এস৷ প্রয়োজনবোধে যেখানে সেখানে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সংগঠিত হবে৷ গরীব গুর্বো মানুষগুলির প্রাণ যাবে৷ সম্পত্তি যতটুকু আছে তা লুণ্ঠিত হবে৷ যেমন হয়েছিল গুজরাতে কিংবা অল্প কয়েক বছর আগে উত্তর প্রদেশের মুজফ্‌ফরনগরে কিংবা গত ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে, খোদ রাজধানীতে৷ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রশাসনকে সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করে বিশেষত, পুলিশ প্রশাসনকে অকেজো করে গণহত্যা সংগঠিত হবে৷ একটি অন্য একটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷ মানবিক বোধ বিধব্স্ত হয়েই চলবে৷

কষিপণ্য বিপণন প্রসঙ্গগুলি গ্যাটের উরুগুয়ে রাউন্ডের আলোচনা শুরু হবার আগে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না৷ কষিপণ্যের দরদাম নিয়ে গ্যাটের অতীত চুক্তিগুলিতে সামান্য উল্লেখ থাকলে তেমন কিছু ছিল না৷ সে তো ১৯৮৬ সালের কথা৷ ১৯৯৩ সালে গ্যাট বিলুপ্ত হয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাWTO তৈরী হল৷ ১৯৯৪ সালের যতদূর মনে পডে বাংলা নববর্ষের দিন এক বঙ্গসন্তান প্রয়াত প্রণব মুখার্জী মরোক্কোর রাজধানী ম্যারাকেশ-এ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের দলিলে ভারত সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করলেন৷ তখন তিনি ভারতের শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত৷ নরসিমহা রা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী৷ এঁদের সম্মতিতেই ভারতের কষি ব্যবস্থা, বিশেষ করে কষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থা বিশ্ববাণিজ্যের প্রদ্ধতি প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পডে৷ এমন হলে ভারতের যেহেতু বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার কিংবা ব্যালান্স অফ পেমেন্ট আদৌ শক্তিশালী ছিল না ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের কষি বাজার উন্মুক্ত করার জন্য তেমন বৈশ্বিক চাপ ছিল না৷ ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজার নির্ভর কষি ব্যবস্থা৷ উৎপাদন বিপণন, দুই ক্ষেত্রেই বহির্বিশ্বের তেমন চাপের কোন প্রসঙ্গ ছিল না৷

শতাব্দী পরিবর্তনের সঙ্গেই ভারতের কেন্দ্রে রাজনৈতিক কর্তত্ব বিস্তারে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টির সাফল্য৷ চবিব্শটি নানা মাপের রাজনৈতিক দল নিয়ে এন ডি এ’র সরকার ১৯৯৮ থেকে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায়৷ এই সব দলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সদ্য গঠিত তণমূল কংগ্রেস এন ডি এ’র শরিক৷ দলটির নেত্রী বা সর্বময় কর্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য৷ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সেইসময় অতি সীমিত হলে দিল্লিতে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ৷ অবশ্য তখন পর্যন্ত তিনি বা তাঁর দলটি ‘রাডারলেস’ বা হালবিহীন৷ ভারতের কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এই দলটিকে তেমন বিশেষ মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না৷ সুতরাং, একটি পারিবারিক দল হিসেবে কোনক্রমে ভেসে থাকাই নেত্রীর উদ্দেশ্য৷ অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে তাঁর বিশেষ আনুগত্য প্রকাশে গুজরাত গণহত্যার দায়ে কলঙ্কিত নরেন্দ্র মোদীকে অভিনন্দিত করে বাংলার ভাবজগৎ এ বিশেষ নিন্দিত ভৎর্সিত৷ এসব সত্ত্বে বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার সমস্ত জনবিরোধী সিদ্ধান্তেই তণমূল কংগ্রেস এক বিশ্বস্ত শরিক৷ কোন সামান্য প্রশ্ন পর্যন্ত করার প্রসঙ্গ ছিল না দলনেত্রীর৷

২০০৩ সালের ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস বা ১ এপ্রিল৷ প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সংসদের রাজ্যসভায় ঘোষণা করলেন যে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আদালতে ভারত অভিযুক্ত হয়েছে৷ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের পর যে সকল নিয়ন্ত্রণ বলবৎ ছিল, যেগুলির মাধ্যমে বড বড বঔজাতিক কোম্পানিগুলি ভারতের বাজারে অবাধে বা কম কাস্টমস্‌ ডিউটিতে তাদের পণ্য বাজারজাত করতে বাধাপ্রাপ্ত হত, সেগুলি প্রত্যাহার করতে হচ্ছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র WTO-র আদালতে অভিযোগ এনেছে যে ভারতের বিপি বা বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার যথেষ্ট ভাল হলে ভারতের আইন বাজার উন্মুক্ত করতে বাধা দিচ্ছে৷ ভারতের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী দুঁদে উকিল অরুণ জেটলি স্বয়ং ভারতের হয়ে লডাই করে পরাস্ত হয়েছেন৷ অতএব ১৪২৯টি পণ্য ভারতে প্রবেশের ছাডপত্র দিতে হচ্ছে৷ সেই তালিকায় অনেকগুলি কষিপণ্য ছিল৷ অর্থাৎ, ভারতের খাদ্যভাণ্ডার অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে পূরণ হলে বিদেশ থেকে আমদানি বাডাতেই হবে, এবং সেই আমদানির ক্ষেত্রে কোন বাডতি ট্যাক্স আরোপ করা যাবে না৷ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে নিদান দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মহামান্য আদালত৷

এই ঘোষণার অল্পকাল পরেই বাজপেয়ী ঘোষণা করলেন যে, ভারতে কষি ব্যবসায় ফিউচার ট্রেডিং বা আগাম বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হচ্ছে৷ মজুতদারী শব্দটি সঙ্গত বঔকারণে এদেশে ঘণ্য শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল৷ দেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে খাদ্যাভাব প্রবল৷ জনসংখ্যা বাডছে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কষি উৎপাদন বাডে নি৷ সেচ ব্যবস্থা আধুনিক কষি সরঞ্জাম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল৷ সবে বহৎ সেচপ্রকল্পগুলি যেমন ভাকরা-নাঙ্গাল, হীরাকুঁদ প্রভতি বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু দৌডে যাচ্ছেন৷ বড বড সেচ প্রকল্পগুলিকে ‘‘জাতির মন্দির’’ বলে অভিহিত করছেন৷ এসবের পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে চাল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল প্রভতি মজুত করে কত্রিম অভাব সষ্টির অপচেষ্টা করেই চলেছে৷ কালোবাজারি চলছে দুরন্ত বেগে৷ জহরলাল নেহরু পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী একজন অসাধু ব্যবসায়ীকে দিল্লির রাজপথে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিতে পারেন নি৷ কিন্তু সেই সুদূর ১৯৫৫ সালে একটি বেশ কঠোর শাস্তির বিধানসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংসদের অনুমোদন সহ গহীত হয়েছিল৷ মানুষের ক্ষুধার অন্ন নিয়ে মুনাফা করার অপচেষ্টা কিছুটা হলে ব্যাহত হয়েছিল৷ পরবর্তী দশকগুলিতে এই বিশেষ তাৎপর্যবাহী আইনটির বাস্তবায়নে ঘাটতি দেখা গেলে প্রাথমিকভাবে এই আইন সার্থকতা পেয়েছিল৷

৫০ পরবর্তী দশকগুলিতে ভারত খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ঠে৷ পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ‘সবুজ বিপ্ল্ব’ খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি সম্ভব করে৷ ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে এই ‘বিপ্ল্বে’র ফল বড বড জমি মালিকদের জীবন ধারাই পাল্টে দিয়েছিল৷ প্রায় চার দশক সময় পেরিয়ে যাবার পরে উপলব্ধি করা গেল যে, অতিরিক্ত জল, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের নির্বিচার ব্যবহারে শষ্য উৎপাদন বাডলে প্রকতি, পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র ধবংস হয়েছে৷ প্রায় সংশোধনাতীত সেই ধবংস৷ তবে এ বিষয় ঠিক যে কঠোর পরিশ্রম এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উদার সহায়তায় এই সব অঞ্চলে নানা শিল্প উদ্যোগ গডে ঠে৷ বর্তমান সময়ে ইসব অঞ্চলে বঔ মানুষের জীবনের মান দেশের অন্যান্য বঔ অঞ্চলের তুলনায় ভাল৷ কষি উৎপাদন অনেক কমে গেলে কষি মান্ডিগুলির সুশঙ্খল ব্যবহার কষিক্ষেত্রে নির্ভরশীল মানুষদের বেশ কিছুটা সুবিধা দিয়েছে৷ কষি-উপকরণ ব্যবহারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আধুনিকতা অর্জিত হয়েছে এই সব অঞ্চলে৷ ভূমি সংস্্কার হয়নি৷ আয় বৈষম্য প্রবল৷ এসব সত্ত্বে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ এবং কর্নাটকের কষকদের গড উপার্জন পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক বেশিই শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে প্বিগুণ৷ আবার দেশের কোন রাজ্যেই কষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সরকারের কোন উল্লেখযোগ্য অবদান লক্ষ করা যায় না৷ শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে বহৎ রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প গডে উঠে সারা দেশে না হলে, বঔ অঞ্চলের মানুষ উপকত হয়েছিল৷ কষিক্ষেত্রে এমন কোন উদ্যোগই লক্ষ করা যায়নি৷ কষির পর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষের নির্ভরশীলতা থাকলে দেশের সরকারগুলির এই ক্ষেত্রে আদৌ যত্নবান ছিল না৷ বিশ্বায়নের হিংস্র আক্রমণ থেকে এদেশের বঔ সহস্র বছরের কষি সভ্যতাকে রক্ষা করতে দেশের কষকদের রক্ষা করার কোন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা কেন্দ্রীয় সরকার নিতে পারেনি৷ আর বর্তমান মোদী সরকার করোনা অতিমারির অনৈতিক সুযোগ নিয়ে দেশের কষি ব্যবস্থাকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির লোভলালসা পূরণ করার লক্ষ্যে নির্বিচারে অতিমুনাফা শিকারীদের কাছে সঁপে দিল৷

একথা ঠিক যে, ভারতের কষি ব্যবস্থা এখন প্রায় সত্তর শতাংশই প্রকতি নির্ভর৷ কষক আকাশের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে একটু বারিসিঞ্চনে তাঁর জমি চাষযোগ্য হয়ে উঠুক, এমন আশায়৷

ভারতে সেচ ব্যবস্থা এখন খুব বেশি হলে ৩০-৩৫ শতাংশ জমিতে চাষ-সহায়ক হয়৷ এছাডা দেশের সর্বত্র জমির উর্বরতা পরিমাপ করা, সয়েল টেস্টিং এর ব্যবস্থা অদ্যাবধি হয়নি৷ কোন জমিতে কত পরিমাণ কী সার লাগবে তা নির্ধারণের কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রায় নেই৷ ‘ক্রপ প্যাটার্ন’ বা শস্যের উৎপাদনের ধরনধারণ কি হয়া উচিত, তা নিয়ে কোন ব্যাপক সমীক্ষা হয় নি৷ একসময় যখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সারা দেশজুডে অনেকগুলি সার উৎপাদন শিল্প কারখানা রমরমিয়ে চলছিল তখন, এই সব রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত অনেক বিশেষভাবে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত গ্রামে গ্রামে পৌঁছে কষকদের সু-পরামর্শ দিতেন এবং কোন জমিতে কি পরিমাণে কোন সার প্রয়োজন তা বলে দিতেন৷ দেশে একাধিক কষি বিশ্ববিদ্যালয় গডে ঠার ফলে বঔ উজ্জ্বল তরুণ কষিক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন৷

অনেক কষিপণ্য জল-নির্ভর এবং প্রচুর পরিমাণে জল সহজে না পায়া গেলে কষকের অত্যধিক পরিশ্রমের পরে উৎপাদন ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ফল পায়া যায় না৷ পূর্বপুরুষদের বা প্রজন্মান্তর থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান নির্ভর হয়ে চাষাবাদ করা পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে কষকদের অনেকক্ষেত্রে বিপজ্জনক ভুল হয়ে যায়৷ বস্তুত নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় সার-বীজ-কীটনাশক প্রভতির ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে দেশি বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কুক্ষিগত হয়ে যাবার ফলে সাধারণ কষক পডেছেন মহা ফাঁপডে৷

বিগত ১৯৯৩ সাল থেকেই কষি ব্যবস্থায় প্রবল সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে চলেছে৷ ইদানিংকালে বিশেষ করে, বিগত ছয় বছর নরেন্দ্র মোদীর অপশাসন কালে কষি উপকরণ, সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ডিজেল প্রভতির দাম এমনভাবে বেডেছে যে দেশের প্রায় সর্বত্র কষক সম্প্রদায় অস্বাভাবিক আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে৷ গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ভারতে কষিনির্ভর মানুষদের যে মত্যু মিছিল বা বলা উচিত, আত্মহত্যার মিছিল চলতে শুরু করেছে তা, আর ব্যাপক এবং জটিল আকার নিয়েছে৷

দীর্ঘ ছয় বছর মোদী সরকার এ প্রসঙ্গে নীরবতা বজায় রেখেছে৷ তারপর হঠাৎ গত ৫ জুন করোনা অতিমারির আবহে দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষ যখন প্রাণরক্ষায় সন্ত্রস্ত হয়ে দিশাহারা, যখন সরকারি নির্দেশে গহের মধ্যে আটক ঠিক তেমন এক সময়ের কাপুরুষের মতো ৫৬ ইঞ্চি একের পর এক অধ্যাদেশ বা অর্ডিনান্স জারি করে মানুষের অধিকার লুণ্ঠনের একতরফা সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে গেছেন৷

দেশের মহামহিম রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করা নিদারুণ বিপজ্জনক৷ দেশদ্রোহী বলে ১২৪এ ধারায় গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে বর্তমান অমানবিক সরকার৷ এসব স্মরণে রেখে উল্লেখ করতেই হয় যে, দেশের রাষ্ট্রপতি নিশ্চিতই প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভার রাবার স্ট্যাম্প নন৷ তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান সিদ্ধ৷ তিনি অবশ্যই মন্ত্রীসভার যে কোন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরৎ পাঠাতে পারেন৷ কোন ব্যক্তি কিংবা দলের দয়া বা কপার অপেক্ষায় তিনি থাকতেই পারেন না৷ রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদার সঙ্গে তা মোটেই সাযুজ্যপূর্ণ নয়৷ কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় যে, ৫ জুন যে বিশেষ উদ্দেশে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি অনুমোদনের সীলমোহর লাগালেন তা তাঁর পদমর্যাদার সঙ্গে, আত্মসম্মানের সঙ্গে বেমানান এবং নিছক বিশ্বাসঘাতকতা৷ কেউ অজ্ঞাতবশত এমন গর্হিত জাতিবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিলেন, এমন কথা কেউ মানবেন না৷ আসলে সবাই এক হয়েই দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অপপ্রয়াসে লিপ্ত৷ শীর্ষ আদালত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সব শীর্ষ ব্যক্তিত্ব একই ছন্দে, একই সুরে জনস্বার্থ বিরোধিতার ‘সিম্ফনি’র যন্ত্রানুসঙ্গে পরিণত৷

বর্তমান নিবন্ধের ব্যাপ্তি পরিমাপ সম্পর্কে সচেতন থেকে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ অন্যান্য বঔ বিষয়ের মতো কষি দেশের সংবিধানে যুগ্ম তালিকায় রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধবংস করে কঠোরভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ মোদী সরকারের বিশেষ ঘোষিত লক্ষ্য৷ এটা সংঘ পরিবারের বিশেষ প্রসঙ্গ৷ তারা বঔকাল যাবৎ ভারতে একটি উচ্চস্তরের সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় সরকার গঠন করার জন্য উদগ্রীব৷ বর্তমান সরকার দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই লক্ষ্যে আগুয়ান৷ প্রায়ই শোনা যায় এক দেশ - এক কর ব্যবস্থা; এক দেশ - এক ভাষা, এক ধর্ম, এক শিক্ষানীতি ইত্যাদি৷ অর্থাৎ, দেশের রাজ্যগুলির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে শুধুমাত্র দেশের পৌরসভাগুলির মতোই৷ রাজ্য সরকারগুলিকে সেভাবেই চলতে হবে৷ অর্থ দেয়া হবে প্রকল্প ভিত্তিক৷ কিন্তু কোন অধিকার আর থাকবে না৷

অধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট যত ঘনীভূত হয়, তার চাইতে দ্রুততার সঙ্গে মানুষের অধিকার লুণ্ঠিত হয়৷ মানুষকে কোন সময়ে কিছু দান দক্ষিণা দেবার সিদ্ধান্ত নিলে কোন সময়েই তাদের এমন কোন অধিকার দেয়া হয় না যা, ব্যবহার করে মানুষ সসম্মান জীবন পরিচালনা করতে পারেন৷ বর্তমানকালে বা মোদীর অপশাসনকালে এই প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়৷ নতুন কোন অধিকারের প্রশ্নই নেই৷ পুরনো অধিকারগুলি জোর করে কেডে নেবার অপচেষ্টা চলতেই থাকে৷ উদাহরণ সহযোগে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই৷ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রেই জানেন৷

শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রায় পূর্ণতই লুণ্ঠিত হয়ে চলেছে৷ যে সমস্ত আইনের ব্যবহারে একজন শ্রমিক বা অনেক শ্রমিক তাঁদের জীবিকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতেন৷ সসম্মান জীবনের সন্ধান করতে পারতেন৷ সেই সমস্ত আইনই বানচাল করতে চলেছে মোদী সরকার৷ কষকদের ক্ষেত্রে একই পথে চলছে সংঘ পরিবার নিয়ন্ত্রিত এই সরকার৷

সাধারণ মানুষের অধিকার কেডে নিয়ে তা অবাধে পুঁজিপতিদের দেয়া হচ্ছে৷ পুঁজিপতিদের স্বার্থে আর নতুন নতুন অধিকারের সন্ধানে প্রমত্ত মোদী-শাহ সরকার৷ এই অপশক্তি যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিনই এমন অনৈতিক আক্রমণ শাণিত হবে৷ এই প্রসঙ্গে কোন সন্দেহ নেই৷

কিছুদিন আগেই নরেন্দ্র মোদী যে ভঙ্গিতে অনৈতিক একপেশে শিক্ষানীতি সম্পর্কে পুরোপুরি মিথ্যা-নির্ভর প্রচার করে গেছেন। এখন কষি ব্যবস্থার সামূহিক ধবংস সাধনের সময়ে তিনি সমান নির্লজ্জ হয়েই ব্যাপক মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন৷ যতদিন যাচ্ছে, ততই একটি সম্পূর্ণভাবে জনস্বার্থ বিধব্স্ত করার লজ্জাহীন রূপ প্রস্ফুটিত হচ্ছে বা পূর্ণতা পাচ্ছে৷ ইদানিং আর কোন রাখঢাক না রেখেই মোদী-শাহর মনুষ্যত্ব বিরোধী ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ আন্তর্জাতিক জাতীয় ক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কাছে তাদের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতে মোদী সরকার বেপরোয়া আচরণ করছে৷ লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে যা খুশি করছে৷ আবার দেখা যাচ্ছে রাজ্যসভায় বিজেপি বিরোধী ভোটে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝে গায়ের জোরে, মার্শালদের অপব্যবহার করে সাংসদদের শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করে অনৈতিক কষি বিল পাশ করিয়ে নিল৷ এই সরকার নিম্নতম স্তরে অবনমিত৷ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যিনি ভারতের উপরাষ্ট্রপতি বটেন, তাঁর ভূমিকা নোংরা বা জঘন্য বললে কিছুই বলা হয় না৷

ভারতীয় জনতা পার্টি এবং এদের সমগোত্রীয় দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলি দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেদের দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি নিবেদিত প্রাণ বলে প্রচার করত৷ পাশাপাশি এইসব রাজনৈতিক শক্তিগুলি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতি আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতো যে, এই দলগুলি গণতন্ত্র বিরোধী এবং দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়৷

গত ২০ সেপ্ঢেম্বর এবং তার পরবর্তীকালে ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থানে যা হলো তা বামপন্থীদের কাছে অতীব বেদনাদায়ক হলে এই ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্র যে veiled dictatorship of the bourgeosie অথবা পুঁজিপতিদের গণতন্ত্রের মুখোশ পডা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ছাডা অন্য কিছু নয় তা বেশ স্পষ্টতই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হলো৷ রাজ্যসভার পরিচালনায় যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হলো তা সাধারণভাবে কল্পনাতীত৷ কিন্তু অসাধারণ সঙ্কটকালে কঠিন ব্যাধিজর্জর পুঁজিবাদের এটাই স্বাভাবিক বেপরোয়া আচরণ বলেই বুঝতে হবে৷